ইতিহাস ও ঐতিহ্য সভ্যতার প্রামাণ্য দলিল। যেকোন জাতির গৌরবময় অগ্রযাত্রায় ইতিহাস অনন্য ক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে পারে। চট্টগ্রামের ‘দো’হাজারী’ ইতিহাস-সমৃদ্ধ এমনই এক এলাকা। মোগল সাম্রাজ্যের সীমান্তদুর্গ ছিল এই দো’হাজারী। মোগল সেনাপতি আধু খাঁ, লক্ষ্মণ সিংহের স্মৃতিবিজড়িত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম আধার এ অঞ্চল। পাহাড়ের বুক চিরে শঙ্খ নদীর সুনীল জলধারা আর অরণ্যের প্রাণছোঁয়া সবুজ এ অঞ্চলকে করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। মানুষ ও পাহাড়ের সখ্যতায় হƒদয়নিংড়ানো সৌন্দর্য আর বিস্ময়কর প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। মোগল বিজয়ের পূর্বে এই অঞ্চলের রয়েছে বিচিত্র অনেক ইতিহাস। হাজার বছর ধরে অনেক জাতি ও রাজ-রাজন্যের উত্থান-পতনের ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল।
অতীতে এ অঞ্চলের শাসন কর্তৃত্ব পরপর বহু রাজশক্তির মাঝে হাতবদল হয়েছে। গৌড়ের সুলতানী শাসন, আফগান বা পাঠান শাসন, পর্তুগীজ, ত্রিপুরার রাজশক্তি, আরাকানীরা এর অভ্যন্তরে নিজেদের দখল সম্প্রসারণ করেছে। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে কখনো চট্টগ্রামকে কেউ স্বীয় অঞ্চলে পরিণত করতে সক্ষম হয় নি। যদিও সাময়িকভাবে দখলে থাকাকালে এর উত্তরাঞ্চল ত্রিপুরা রাজ্য এবং দক্ষিণাঞ্চল রোসাঙ্গ রাজ্যরূপে অভিহিত হয়েছে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক রাজনৈতিক কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠী চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করার ফলে এখানকার সমাজ ও সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যে সৃষ্টি হয় নানান জটিলতা। তাই বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার ইতিহাস এবং সমাজ-সংস্কৃতি থেকে চট্টগ্রাম বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
বিশেষভাবে গৌড়ের সুলতানী আমলে ও বাংলার সুবেদার নবাব শাহজাদা সুজার আরাকান পলায়নকালে বিপুলসংখ্যক মুসলমানের আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। অতঃপর মোগল কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়কে কেন্দ্র করে তার ব্যাপ্তি আরও সমৃদ্ধ হয়। বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে আপন পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁকে প্রধান সেনাপতি নিয়োজিত করে আরাকান অভিযানে প্রেরণ করেন। উমেদ খাঁ একই বছরের ২৭ জানুয়ারি আরাকানের প্রদেশ শহর বন্দরনগরী চট্টগ্রাম দখল করে নেন। মাত্র ১২ দিনের মধ্যে উমেদ খাঁ দক্ষিণে রামু পর্যন্ত দখল করতে সক্ষম হন। কিন্তু নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে রামু ত্যাগ করে শঙ্খ নদীর তীরে এসে দুর্গ স্থাপন করে মোগল সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করেন। এই দুর্গের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন দু’হাজার সৈন্যের অধিনায়ক আধু খাঁ ও লক্ষ্মণ সিং। মূলত তাদেরই নেতৃত্বে দক্ষিণে নাফ নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল আরাকানীদের দখল থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু এই গর্বের ইতিহাস আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। মোগল শাসন বিলুপ্ত ও ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে মোগলযোদ্ধারা পরিবার পরিজন নিয়ে এই অঞ্চলে বসবাস- করলেও তাদের তথ্য-উপাত্ত কোথাও গ্রন্থিত হয় নি। তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য সম্পর্কে নিজেরাও অবগত নয়। ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য।
সৃজন ও সমীক্ষার ক্ষেত্রে মানুষ সবসময় সন্ধান করে পূর্বপুরুষদের, খুঁজে বেড়ায় অতীতকে। অতীতের সবকিছু নির্বিচারে গ্রহণ না করলেও অতীত শক্তি যোগায় নতুন পথে এগুবার, পাথেয় হয় পথ চলার। সময় সবকিছুকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পালায় কিন্তু পারে না একেবারে মুছে দিতে, নিজের অজান্তেই রেখে যায় চিহ্ন। এ চিহ্নটুকু ছাপার অক্ষরে ধরে রাখার জন্যেই এই প্রয়াস। এই প্রয়াসে অনেক অপূর্ণতা আছে, আছে অনেক ত্র“টি-বিচ্যুতি। অনেকটা বিবেকের তাড়নায় আমি দীর্ঘদিন ধরে ছুটে চলেছি এ পার্বত্য জনপদে। নিজের অক্ষমতার কথা জেনেও এ পার্বত্য জনপদের ক্ষত-বিক্ষত ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া পুরাতত্ত্বের ঐতিহাসিক উপাদানের খণ্ড-বিখণ্ড যেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ; শুধু চেয়েছি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে তুলে ধরতে, তা করতে গিয়ে অতীতকে দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। তারপরও অনেক কিছুর খোঁজ নিতে পারি নি সময় ও সাধ্যের সীমাবদ্ধতায়।
তথ্য-উপাত্ত ও সাহস দিয়ে সহযোগিতা করেছেন অনেকে। প্রত্যেককে আমি শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
জামাল উদ্দিন
Reviews
There are no reviews yet.