শিশুরা মায়ের কোলে মায়ের দুধ পান করতে করতে মায়ের মুখেমুখে প্রথমে যে ভাষা শিখে প্রকৃত পক্ষে সে ভাষাই তাদের মাতৃভাষা। শিশুর সু-স্বাস্থ্য গঠনে যেমন মায়ের দুধের বিকল্প নেই তেমনি তার মানসিকতার বিকাশ সাধনেও তার মাতৃভাষার বিকল্প নেই। তাই মাতৃভাষার সাথে মানুষের দেহের, মনের এবং সর্বোপরি নাড়ির এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই কারণেই মানুষ তার মাতৃভাষায় যেভাবে বিকশিত হয়ে আপন মনের আবেগ, আকুতি, অনুভূতি ইত্যাদি মর্মস্পর্শী করে প্রকাশ করতে পারে ভিন্ন ভাষায় কিন্তু তার আদৌ পারে না। তার বিম্বিত স্বাক্ষ্য এবং কালজয়ী প্রমাণ মাইকেল মধুসূধন দত্ত।
এই ঐতিহাসিক মহাসত্য এবং মাতৃভাষার গুরুত্ব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরে বাংলার দামাল ছেলেরা পাকিস্তানী শাসকদের হীন ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেওয়ার ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্র“য়ারি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে এবং অকাতরে তাদের জীবনদান করে এই প্রাণপ্রিয় মায়ের ভাষা ধরে রেখে প্রমাণ করেছে আপন মাতৃভাষা আপন বুকের রক্ত এবং জীবনের চেয়ে অধিকতর দামী।
তাদের এই রক্ত এবং জীবন দানের রেশ ধরেই ১৯৭১ সনে আমরা পুনঃ আরো একসাগর রক্ত এবং ২৫ লক্ষ জীবন দিয়ে ছিনিয়ে এনেছি মহান স্বাধীনতা এবং কালক্রমে আরো লাভ করেছি এই ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, চট্টগ্রাম জেলায় আমার জন্ম বলে খাঁটি বাংলার পাশাপাশি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাই আমার প্রথম এবং প্রধান মাতৃভাষা। কারণ আমি এই ভাষায় প্রথম শিখেছি মাকে ‘অমা’ এবং বাপকে ‘অবা’ ডাকতে।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হালে নব্যসভ্যতার ঠেলায় একদিকে যেমন তেলইন, পাইল্লা, ফোরইন, ফোঁক্কা, গাট্টা, কলকি, টিক্কা, ফুঁইছা, জোনা, বেণা, কঁঅইর, খরম, বদ্দুয়ার, ঠেঁয়ারবারী, মোয়ামুইন্না, কত্তি, থাচ্ছিক্কা, দলাবারী, অয়ন, নাফা, নাক্কল, পুঁউচি, মুকরশা, বাতনা, পঅর খারু, চইন, হানক ইত্যাদি দ্রব্য সামগ্রী বিলুপ্তির সাথে সাথে এদের নামও চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আবার খাঁটি বাংলার এবং ভিনআন ভাষার ভিন্ন শব্দাবলী সভ্যতার উজ্জ্বল আবরণে আচ্ছাদিত হয়ে অতি সুকৌশলে আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় ঢুকে পড়ে এর স্থান দখল করে নিচ্ছে।
যেমন মাকে ‘মাম্মী’ বাকে ‘আব্বু’ খালাকে ‘আন্টি’ কাকুকে ‘আংকেল’ বদ্দাকে ‘ভাইয়া’ বব্বুকে ‘আপু’ গুন্নিকে ছোট, খারুকে ‘চুড়ী’ ইত্যাদি।
এই ভাবে যদি বিলুপ্ত দ্রব্য সামগ্রীর সাথে সাথে এদের নামও চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং হাঁটি হাঁটি পা পা করে ভিন্ন ভাষার শব্দাবলী ছদ্মবেশে এই ভাষার স্থান দখল করতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই ভাষা শুধু চর্ম খসা নয়, তার আসল রূপ, রস, গন্ধ এবং আমেজ হারিয়ে অন্তসার শূন্য হয়ে যেতে পারে। তাই এই ভাষার বর্তমান রূপ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে অবিকলভাবে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আমার এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমি এখানে একই মোড়কের অন্তরালে ‘এক বইউমত দুই ডইল্লা আচার, বইটিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা বিভিন্ন সাধের বত্রিশটি ছড়া ও সাতান্নটি গান সন্নিবেশিত করেছি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এটি আমার প্রথম প্রকশনা বলে শব্দের গাঁথুনিতে, গানের অন্ত্যমিল সমূহে ভুল থাকতে পারে, থাকারই কথা। যদি এমন হয় তা একান্ত অনিচ্ছাকৃত।
সুহৃদ পাঠকের কাছে আমার এই প্রমাদ তুচ্ছ বলে আমি প্রত্যাশা করবো। আমি আরও আশা করশি ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা গবেষণার্থে আমার এই চাটগাঁইয়া ছড়া ও গানের বইটি অনুসন্ধানী পাঠকদের কাজে আসবে।
আমি প্রথমে শ্রদ্ধা জানাই সিলেট জেলার বিশিষ্ট শিল্পপতি মির্জা নোয়াব মিয়া সাহেবকে। যাঁর øেহমাখা ভালোবাসা আমার পথচলার ক্ষেত্রে সাহস যুগিয়েছে।
আমি আমার কৃতজ্ঞ চিত্তে ধন্যবাদ জানাই দেশের বরেণ্য গীতিকবি ও সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দীন এবং চট্টলার খ্যাতনামা সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশন ‘বলাকা’ কর্তৃপক্ষকে। যাদের স্বযতœ সহযোগিতা আমার এ গ্রন্থ প্রকাশনায় সহজতর করে দিয়েছে।
পরিশেষে এই গ্রন্থ প্রকাশনার জন্যে সুপরিচিত জনবান্ধব এ.কে.খান ফাউন্ডেশনের সুযোগ্য ট্রাস্টের সেক্রেটারী জনাব ছালাউদ্দীন কাশেম খান এবং ফাউন্ডেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিনন্দন এবং সশ্রদ্ধ মোবারক বাদ। তাঁদের এ ঋণ কখনো শোধ হবার নয়।
আফছার উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরী
মোহাম্মদ দায়েম চৌধুরী বাড়ি,
গ্রাম- দৌলতপুর, ডাকঘর- নাজিরহাট, চট্টগ্রাম।
Reviews
There are no reviews yet.